বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী আলফি শাহরিয়ার মাহিম জামিন পেয়েছে।
কারাগারে যাওয়ার ১৩ দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর করে রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত।
এ ক’দিনে একদিনও সন্তানকে দেখতে পাননি মাহিমের বাবা মো. শাহরিয়ার। বৃহস্পতিবার বিকালে বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার সময় ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতির কথা জানান তিনি।
মূলত, গত ১৮ই জুলাই বিকালে মাহিমকে আটক করে রংপুর পুলিশ এবং তার ঠিক পরদিনই তাকে আদালতের মাধ্যমে ‘পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের’ হত্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।
তার বোন সানজানা আখতার স্নেহা গত ৩১শে জুলাই এ নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন এবং লেখেন যে গ্রেফতারের দিন রাতে তাদের বাবার কাছে “একটা কল” আসে এবং বলা হয়, “আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে, জানাজানি করিয়েন না। তাতে ছেলের ক্ষতি হবে।”
মিজ স্নেহার ভাষ্য মতে, পরদিন শুক্রবার মাহিমকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও ছাড়া হয়নি। বরং, ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কল দিয়ে জানানো হয় যে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ভাইয়ের নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে শুরুতে বিষয়টি বাইরের কাউকে না জানালেও ৩১শে জুলাই মিজ স্নেহা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান এবং প্রশ্ন করেন, “সেদিন থেকে বার বার কারাগারের দরজা থেকে ফিরে এসেছি, একটা বার দেখা তো দূর, তার কণ্ঠও শুনতে দেয়নি কেউ…যে ছেলেটা লিগাল ডকুমেন্টস অনুযায়ী শিশু, তাকে তারা কোন হিসাবে এভাবে হ্যারাস (হয়রানি) করাচ্ছে?”
স্নেহার সেই পোস্ট রাতারাতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষ এ নিয়ে কথা বলা শুরু করে। এরপরই এ বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন এবং মাহিমকে আগাম জামিন দেয়।
মাহিমকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়াকে ‘শিশু আইনের ব্যত্যয়’ হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন ব্যত্যয় এবারই প্রথম না
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মাতুয়াইল হাসপাতালের বিপরীত পাশে এক পুলিশ সদস্যকে মেরে ঝুলিয়ে রাখার মামলায় ১৭ জন আসামির মধ্যে ১৬ নম্বর আসামি হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ।
জন্মসনদ অনুযায়ী, ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থীর বয়স ১৭ বছর। গত ২৪ জুলাই বুধবার রাতে ফাইয়াজকে বাসা থেকে আটক করে যাত্রাবাড়ী থানায় রাখা হয়।
চারদিন তাকে ডিবি কার্যালয়ে রাখার পর গত ২৭শে জুলাই শনিবার হাতে দড়ি বেঁধে নিম্ন আদালতে হাজির করা হয় এবং পুলিশের পক্ষ থেকে রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তখন তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফাইয়াজের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ‘ফাইয়াজকে দড়ি বেঁধে পুলিশ ভ্যানে তোলা এবং রিমান্ডে নেওয়ার বিরুদ্ধে’ রিট আবেদন করলে সোমবার তার রিমান্ড বাতিল করে আদালত। পরে ফাইয়াজকে গাজীপুরের টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেয় শিশু আদালত।
প্রথমে কিশোর মাহিম, এরপর ফাইয়াজ; পরপর দু’টো ঘটনায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার আইনের ব্যত্যয় হওয়ার কারণ “পুলিশের প্রশিক্ষণের অভাব” বা “অজ্ঞতা”।
আইন কী বলছে?
সেই আইনে বলা হয়েছে, “বিদ্যমান অন্য কোনও আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।”
সেখানে আরও বলা হয়েছে, শিশুর মাধ্যমে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করবে শিশু আদালত এবং অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অথবা বিচারে দোষী সাব্যস্ত শিশুকে সাধারণ জেল হাজতের পরিবর্তে নিরাপদ হেফাজতে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখতে হবে।
গ্রেফতারের ব্যাপারে আইনের ৪৪ ধারায় বলা আছে, “এই ধারায় যাহা কিছুই থাকুক না কেন, নয় বছরের নিম্নের কোনও শিশুকে কোনও অবস্থাতেই গ্রেফতার করা বা, ক্ষেত্র মতে, আটক রাখা যাইবে না।”
আর, গ্রেফতার করার পর কোনও শিশুকে “হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না।”
বয়স নির্ধারণের জন্য শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদ অথবা, সনদের অবর্তমানে স্কুল সার্টিফিকেট বা স্কুলে ভর্তির সময় উল্লেখ করা তারিখসহ প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বিবিসিকে বলেন, “গ্রেফতারের আগে বয়স কত, পুলিশকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর গ্রেফতারের পর কিশোর যদি বলে যে তার বয়স ১৮ বছরের কম, তবে কিশোরকে তা প্রমাণ করতে হবে না। সে বলার পর পুলিশকেই সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন যে “অপরাধমূলক কাজ করলে বিচারের জন্য শিশু আদালতে পাঠাতে হবে এবং আদালত জামিন না দিলে টঙ্গীতে (শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে) পাঠাতে হবে, সাধারণ জেলে নয়।”
কিন্তু মাহিমকে তো টানা ১৩ দিন সাধারণ জেলে রাখা হয়েছেই। আর, ফাইয়াজের ক্ষেত্রে তার বিচার শিশু আদালতে না হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হয়েছে, যা পুরোপুরি আইন বহির্ভূত।
সেইসাথে, ফাইয়াজকে গ্রেফতারের চারদিন পর আদালতে হাজির করার মাধ্যমেও আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদার সাথে কথা হয় বিবিসি বাংলার।
তিনি বলেন যে “কোমড়ে দড়ি দিয়ে নেওয়া যায়, যদি সেরকম পরিস্থিতি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখে মনে হয়েছে যে তাকে (ফাইয়াজকে) এমনি নিয়ে যাওয়া যেত।”
“দড়ি বা হাতকড়ার বিষয়ে পুলিশের রেগুলেশনে বলা আছে, তুমি পরিস্থিতি বুঝে করবা। করবে না, এরকম বলা নাই,” যোগ করেন মি. হুদা।
মাহিম প্রসঙ্গে সাবেক এই আইজিপি জানান, অভিযুক্ত বা আসামির বয়স “১৮ বছরের নিচে হলে সাধারণ কয়েদিদের সাথে রাখা যায় না। আলাদা কোর্টে নিতে হয়। এখানে পুলিশ অফিসারের যদি অজ্ঞতা থাকে, তাহলে তার জন্য সে দায়ী। তার জানতে হবে এটা। আর যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিবে, তার তো আরও জানার কথা।”
তিনি বলেন যে কাগজপত্র যাচাই করার উপায় না থাকলে “মেডিকেল পরীক্ষা” করেও বয়স বোঝা যায়।
এখন, কেউ যদি মনে করেন যে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন, তবে ভুক্তভোগী “পুলিশের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা” করতে পারেন বলেও জানান মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
‘ওদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন’
অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব কিশোর আইনের ব্যত্যয়ের শিকার, তাদেরকে “একটা লাইফ-লং ট্রমা’র মাঝ দিয়ে” যেতে হবে। তাই, তাদের “কাউন্সেলিং” প্রয়োজন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ফাইয়াজের গ্রেফতারকে বর্ণনা করেন এভাবে, “যখন তাকে দড়ি বেঁধে নিচ্ছে, তখন ছেলেটা মাথা নিচু করে চোখ ঢেকেছে। তার মানে সে বুঝতে পারছে যে এটা তার জন্য কতটা অবমাননাকর…তার ছবিটা মিডিয়াতে যাচ্ছে। বিশ্ববাসী, সারাদেশের মানুষ, তার এলাকার মানুষ তাকে দেখছে।”
তিনি বলেন, “এখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আমরা বিব্রত…হয় এখানে পুলিশের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বা তারা যে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাতে গাফিলতি আছে।”
“যেসকল পুলিশ কর্মকর্তা এটি করেছেন, তাতে বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে,” জানান মিজ হালিম।
তার মতে, যাদের সাথে এটা হয়েছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সেলিং প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম. নাজমুস সাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের দেশে যে সমস্যা হয়েছে, বেশিরভাগ সময়ে পুলিশ যখন এই বয়সের কাউকে গ্রেফতার করে, তার বয়স নির্ধারণ করার জন্য যে ধরনের তথ্য-প্রমাণ দরকার হয়, প্রাথমিকভাবে পুলিশের কাছে তা থাকে না। আর যাকে গ্রেফতার করা হয়, তার কাছেও থাকে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”
বিষয়টিকে “মিসকমিউনিকেশন” হিসাবে সঙ্গায়িত করে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেতনভাবে যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এই ধরনের কনফিউশন বা ম্যালপ্র্যাকটিস থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।”
“এই বয়সী কিশোর জন্য এটা লাইফ-টাইম ট্রমা। সেজন্যই তাদেরকে কারাগারে না, সংশোধনাগারে পাঠানো হয়; তারা যেন সত্যিকারের অপরাধীদের সাথে মিশতে না পারে।”