বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণার সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার রীতি বেশ পুরনো। এবারের অন্তর্বর্তী সরকার সেই বিধি ও রীতি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, এখান থেকে সরকার যে টাকা আনতে পারে, সে টাকা দিয়ে যে সরকারের খুব বেশি কিছু এগোয় তা নয়। বরং মূল্যবোধটার অবক্ষয় ঘটে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে বলেও জানান এই উপদেষ্টা।
শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে।
সর্বশেষ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ নির্দিষ্ট হারে আয়কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার বিধান বহাল রাখা হয়।
সেইসাথে জমি, ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদের তথ্য যদি কেউ গোপন করে বা অবৈধ অর্থ দিয়ে কেনে সেটাও নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে বৈধতা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়।
সে সময় সরকারি ও বিরোধীদলের অনেক সদস্য এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও কোনো পরিবর্তন আনেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কালো টাকার বিষয়টি দু’রকমের হয়। কেউ যদি অবৈধভাবে উপার্জন করেন, তাহলে সেটি কালো টাকা। অবৈধ উপার্জনের বিষয়টি সাধারণত আয়কর নথিতে দেখানো হয়না।
এছাড়া অনেকে হয়তো বৈধভাবে আয় করেছেন, কিন্তু আয়কর ফাঁকি দেবার জন্য সব টাকা বা সম্পদ আয়কর নথিতে দেখাননি। তখন সেটি কালো টাকা হয়ে যায়।
বিগত সরকার মূলত অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকাকে অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আসছে।
এভাবে অপ্রদর্শিত অর্থের মোড়কে অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে শুরু থেকেই বৈষম্যমূলক এবং অনৈতিক বলে দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেননা যেখানে একজন সৎ ও নিয়মিত করদাতা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর দিয়ে থাকেন। সেখানে যিনি কর ফাঁকি দেন বা কালো টাকার মালিক তিনি মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেই অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ পান। কোন জরিমানাও দিতে হয় না।
এর আগে টাকা পাচারকারীদেরও নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এমন সব সিদ্ধান্তে একটা প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্র অসৎ নাগরিকদের উৎসাহিত করেছে কিনা।
এই ব্যাপারে বিগত সরকারের পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালন বাড়ার কারণে রাজস্ব আদায় বাড়বে এবং টাকা পাচার রোধ করা যাবে।
এতে সরকারের বাজেট ঘাটতি কমবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে কালো টাকা তেমন ভূমিকা নেই বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। কেননা বার বার সুযোগ দিয়েও বাংলাদেশের কর-জিডিপি বাড়েনি বলে জানান অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কালোর টাকার পরিমাণ যদি ৪০ শতাংশও তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়াত পারে ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো।
সেখানে এনবিআর তথ্য মতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। যা কালো টাকার মোট পরিমাণের নগণ্য একটি অংশ।
এই সামান্য পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য নৈতিকতা বিসর্জন দেয়াকে সমালোচনা করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা হিসাব করে দেখেছি এই কালো টাকা সাদা করে সরকার যা পায় সেটা এমন কিছু না। বরং এতে নৈতিকতার যে অবক্ষয় হয়, অপরাধীরা ক্ষমতাবান বলে শাস্তি পায় না। এখন থেকে এমনটা আর হবে না।”
সেই সাথে অর্থ পাচারের রোধ করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, “কালো টাকাকে বৈধতা দেয়ার সুফল পাওয়ার কোন প্রমাণ নেই। এমন সুবিধার মাধ্যমে মূলত কালো টাকা সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং দেশে দুর্নীতি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে”।
তিনি বলেন, বার বার এই সুযোগ দেয়ার ফলে ‘দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র’ থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। সেই সাথে এই সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে সৎ ও বৈধ আয়ের করদাতাদের সঙ্গে ‘বৈষম্যমূলক আচরণ’ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে এবারে যেহেতু এই সিদ্ধান্ত বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাই তিনি প্রত্যাশা করেন চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যেন চিরতরে বাতিল করার মতো আইনি কাঠামো তৈরি করার হয়।
সেই সাথে যে কালো টাকা পাচার হয়েছে সেগুলো ফেরত আনার ব্যাপারেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মি. জামান বলেন, “পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক আইনে এর সুযোগ আছে। এজন্য যেসব দেশে যতো অর্থ পাচার হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এখন এই কাজগুলো করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে”।
তবে কালো টাকা সাদা করার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়টি এখনো নীতিগত পর্যায়ে আছে বলে জানান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আমরা এখনও প্রক্রিয়া শুরু করিনি কেবল নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এই অর্থ বছরে আর কোন কালো টাকা সাদা করা হবে না। আমরা এটাকে একটা আইনি কাঠামো দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাবো”।
তবে ইতোমধ্যে যারা কালো টাকা সাদা করতে আবাসন বা পুঁজিবাজারের মতো খাতে বিনিয়োগ করেছেন সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে কী না?
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত আগের অর্থবছরের কোন সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। তবে যারা কালো টাকা সাদা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তারা আগে কী করেছেন সে হিসাব নেয়া হবে”।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিলের উদ্যোগকে একেবারেই প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি মনে করেন, অর্থনীতির কোথায় কোথায় কালো টাকা আছে সেটা বের করার মতো সরকারের কাছে যথাযথ পদ্ধতি নেই। যখন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তখনই নানা তদন্তের ভিত্তিতে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমন্বিত অর্থনৈতিক লেনদেন নজরদারি করার মতো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
যার আওতায় ফরেন এক্সচেঞ্জ, পুঁজিবাজার, জমি-জমা, স্বর্ণসহ সব ধরণের অর্থ-সম্পদ লেনদেন সেইসাথে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি সনাক্ত করা যাবে।
এই স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা গেলে অর্থনীতি কালোটাকা মুক্ত করা সম্ভব বলে তিনি জানান। এর বাইরে শুধু ঘোষণার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় কোন পরিবর্তন আশা করছেন না তিনি।
“এটি ধারাবাহিক অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে একটি পদক্ষেপ। যতদিন না প্রতিটি আর্থিক লেনদেনকে সরকারের নজরদারি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র এই ঘোষণার মাধ্যমে তেমন পরিবর্তন আসবে না। সরকারের একটি বার্তা দিতে হবে যে, সরকার চাইলে যেকোনো মানুষের লেনদেন নজরদারি করতে পারেন। তাদের সনাক্ত করার পর ব্যবস্থা নিতে পারেন।” তিনি বলেন।
এমন স্বয়ংক্রিয় কোন ব্যবস্থা নেই বলেই কালো টাকাধারীদের এই সুযোগ নেয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। কেননা তিনি সুযোগ না নিলেও এটা বের কোন উপায় সরকারের কাছে নেই।
তবে তার মতে, কালো টাকা অবৈধ উৎস থেকে এসেছে, এটা যদি কোনভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ সবসময়ই থাকে। এই সিদ্ধান্ত বাতিল হলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যাবে।
এক্ষেত্রে অর্থ সংক্রান্ত জটিলতা যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা যায় এজন্য অর্থ ঋণ আদালতের আইনগত সংস্কারের জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে যেহেতু কালো টাকা আছে এক্ষেত্রে এমনভাবে উদ্যোগ নিতে হবে যেন কালো টাকার অর্থের সঞ্চালন কমিয়ে আনা যায়।
এক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়ে সব আর্থিক লেনদেনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং বেনামী অর্থের হিসাব বন্ধ করে দেয়ার মতো কড়া পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন মি. মোয়াজ্জেম।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন সরকারের আমলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে দেখা গেছে।
দেশে প্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। এরপর সতেরো বার সেই সুযোগ পায় অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধান ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া মানি লন্ডারিং আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর আয়কর অনুবিভাগের বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তিতে একটি ন্যায়-ভিত্তিক কর ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অথচ এই সুযোগ তাদের প্রতিশ্রুতির সাথেও সাংঘর্ষিক।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অনেক দেশেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। ওইসব দেশে সুযোগ দেওয়া হয় সীমিত সময়ের জন্য এবং সুযোগ না নিলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।
কিন্তু বাংলাদেশে কালো টাকা সৃষ্টির ক্ষেত্রগুলো হল, ঘুষ-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, জমি দখল, চোরাচালান, জুয়া, মাদকদ্রব্য/অস্ত্র বা যেকোনো নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা এবং এতে সম্পৃক্ত একটি বড় অংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
এ ব্যাপারে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “মূলত ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। যেখানে এই অবৈধভাবে উপার্জনকারীদের শাস্তি দেয়ার কথা তাদের উল্টো পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত যতোটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।”