কেমন যাচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পতন হওয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়, বন্যার পানি, সীমান্তহত্যা, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর উসকানিমূলক বক্তব্য, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ইলিশ রপ্তানি ইত্যাদি নানা ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের টানাপোড়েন চলছে।

৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় তীব্র বন্যা দেখা দেয়। ভারতের উজান থেকে পানি আসায় ফেনীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলা পানিতে ডুবে যায়। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা সেসময় অভিযোগ করেন, আগাম নোটিশ ছাড়াই ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ এমন আকস্মিক বন্যার মুখে পড়েছে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে ডুম্বুর বাঁধ খোলা নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই বাঁধের জন্য বাংলাদেশে বন্যা হয়নি। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়।

এর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। সেখানে তাকে আশ্রয় দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার হলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ নিয়ে খোলাখুলি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, ভারত তাকে সেখানে রাখতে চাইলে শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে হবে। গণহত্যার অভিযোগে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর বিচার শুরু হলে তাকে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানানো হয় ঢাকার পক্ষ থেকে।

বিগত সময়ের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বগ্রহণের পরও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডে ঘটেছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার সীমান্তে কিশোরী স্বর্ণা দাশ ও ঠাকুরগাঁও সীমান্তে কিশোর জয়ন্ত কুমার সিংহ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হয়। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখায় ঢাকা। পৃথক দুটি ঘটনায় ভারতের কাছে দুইটি কড়া প্রতিবাদপত্রও পাঠায় বাংলাদেশ।

সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর একটি মন্তব্য ঘিরেও ঢাকায় অসন্তোষ দেখা গেছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে এক সমাবেশে অমিত শাহ মন্তব্য করেন, ‘আমরা প্রত্যেক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করব। ’ অমিত শাহর এই বক্তব্যে আপত্তি তুলেছে বাংলাদেশ। তাদের এই ধরনের আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে আলোচনাও তোলেন। এছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে খবর প্রচার করা হয়।

যদিও এক্ষেত্রে ভারতীয় গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি ঢাকাকে বিরক্ত করেছে। খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই এ নিয়ে কথা বলেছেন। ১৬ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে তিনি বলেন, সংখ্যালঘুসহ বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার প্রতিশ্রতিবদ্ধ।

ভারতীয় মিডিয়ায় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের প্রতিবেদন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদেরই বাংলাদেশে আসার আহ্বান জানান এবং সংখ্যালঘুদের ইস্যু নিয়ে তাদের মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন করতে বলেন।

এদিকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিয়েও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে শীতলতা দেখা যায়। পূজার মৌসুমে প্রতিবারের মতো এবারও ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হবে কি না, তা নিয়ে প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল সরকার। পরে সুস্বাদু এ মাছটি রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আসন্ন দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে ভারতের বাজারে পদ্মার ইলিশ যেতেও শুরু করেছে।

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়ার আগে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। সমস্যা স্বীকার না করলে, সেটা সমাধান করা যাবে না। তবে টানাপোড়েন কাটিয়ে ওঠার জন্য আলোচনা হবে। এ বিষয়ে নিউইয়র্কে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। ’

পরে নিউইয়র্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকও করেন তৌহিদ হোসেন। ২৪‌ সে‌প্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বার্তায় জানায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বৈঠক ক‌রেন তৌ‌হিদ ও জয়শঙ্কর। তারা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠ‌নের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে এটিই প্রথম কোনো বৈঠক।

এদিকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ‘অনন্য উচ্চতায়’ বলে দুদেশের নেতাদের তরফ থেকেই বিভিন্ন সময় বলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই সম্পর্কে অস্থিরতা-টানাপোড়েন দেখা দিলেও দিল্লি বলে আসছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে চায়।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এশিয়া সোসাইটি ও এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘ভারত, এশিয়া ও বিশ্ব’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে জয়শঙ্কর আশা প্রকাশ করে বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

Source link

এই পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে ফেইসবুক পেজটি লাইক দিন এবং এই রকম আরো খবরের এলার্ট পেতে থাকুন

 আরো পড়তে পারেন:  

Loading...