ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে ‘বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ’ খ্যাত বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি’র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ওই হলেরই একজন শিক্ষার্থী।
গত ১৯শে নভেম্বর বিকেলের দিকে এই ঘটনাটি সামনে আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেন, যা এখনও চলছে।
ঘটনার পরদিনই ওই হলের শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে হলের প্রাধ্যক্ষ’র গোচরে এনেছিলেন। পরে তিনি স্নাতোকোত্তর পড়ুয়া ওই নারী শিক্ষার্থীকে ডাকেন।
ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে তার কাজের জন্য ক্ষমা চান ও পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মাঝে গ্রাফিতিটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
যদিও শেষ পর্যন্ত গ্রাফিতিটি তার ঠিক করার প্রয়োজন পড়েনি। নির্ধারিত সময়ের আগেই ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা তা ঠিক করে দিয়েছেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে, যিনি সবার কাছে বেগম রোকেয়া নামেই বেশি পরিচিত, ঘিরে এমন আরও একটি ঘটনা এই সাম্প্রতিক সময়েই ঘটেছে।
কয়েকদিন আগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
ইতোমধ্যে এ বিষয়ক একটি স্মারকলিপিতে গণস্বাক্ষর করে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর জমাও দিয়েছেন তারা। যদিও নাম পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব যুক্তি রয়েছে।
কিন্তু এই দু’টো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে চাইছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, এই দু’টো ঘটনাই আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ও ধর্মীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ির ফলাফল।
যে কারণে গ্রাফিতিতে কালো রং
শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই মেয়েটি দু’টো ছবিতে কালো রঙের স্প্রে করেছিলো। তার মাঝে একটি হলো বেগম রোকেয়ার।
প্রথমে, একটি ফেসবুক পোস্টে মেয়েটি নিজেই মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি-ই কালো রঙ করেছেন।
কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “ছবিগুলোর মুখের কারণে বারান্দা থেকে নামাজে একটু সমস্যা হয়।”
পরে তাকে ওই পোস্টে সবাই প্রশ্ন করতে থাকলে তিনি দ্বিতীয়বার বলেন, “বারান্দায় গেলে ওই মুখগুলো আমায় বিরক্ত করতো। তাই আমি সেগুলোকে ঝাপসা করে দেয়ার চেষ্টা করেছি।”
সেখানে তখন নুরে জান্নাত সুজানা নামক একজন লেখেন, “আপনি প্রথমে বললেন নামাজে সমস্যা হয়। এখন বলছেন যে ব্যালকনিতে গেলে ইরিটেট লাগে। আপু, ক্লিয়ার করেন আপনার এজেন্ডা।”
মেয়েটি নিজেই ওই কথা স্বীকার পর তা নিয়ে ফেসবুকে বাকযুদ্ধ লেগে যায় এবং সেই ছবি-স্ক্রিনশটও ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জনের প্রোফাইলে। পরে ২০শে নভেম্বর বিকেলে হলের অন্যান্য নারী শিক্ষার্থীরা কালো কালিতে ঢাকা বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতির ছবি প্রাধ্যক্ষকে পাঠান।
সাথে ওই নারী শিক্ষার্থীর পরিচয়ও হল প্রাধ্যক্ষকে জানানো হয় এবং এই ঘটনার বিষয়ে “প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিবে কি না”, সেই প্রশ্নও করা হয়।
হল প্রাধ্যক্ষ জানান, ঘটনা জানতে তিনি প্রথমে ফ্লোর টিচারকে ওই শিক্ষার্থীর কাছে পাঠান। তিনি সেই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন এবং সেখানে অসংলগ্নতা খুঁজে পান।
তিনি জানান, “মেয়েটি লিখিতভাবে জানিয়েছে যে ও-ই এটি করেছে এবং ভুল করেছে। ভবিষ্যতে এমনটা করলে হল প্রশাসনের সব সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। এবং, যে গ্রাফিতি নষ্ট করবে, তা সে ঠিক করে দিবে ২৪ ঘণ্টার মাঝে। পরদিন সেই শিক্ষার্থী নীলক্ষেত থেকে কিছু জিনিস কিনেও এনেছিলো ঠিক করার জন্য। কিন্তু তার কিছু করার আগেই “চারুকলার ছেলেমেয়রা গ্রাফিতিটা ঠিক করে দিছে।”
তবে, “ওর মোটিভ আমরা এখনও বুঝিনি। ও ভুল করে করেছে নাকি ওর কোনও অবজেক্টিভ আছে,” যোগ করেন শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা।
গ্রাফিতি’র কালো রঙের পেছনের রাজনীতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতিতে কালি লেপন করার পেছনে অনেক অর্থ আছে।
তার মাঝে প্রথমটি হলো, এটি একটি নারীর ছবি। দুই, বেগম রোকেয়ার প্রতি ঘৃণার প্রকাশ।
কারণ “নারী শিক্ষা, নারীর চিন্তা করার জগৎ, নারীর স্বাধীনতা, নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’র ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া একটি বড় অবদান রেখেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অধ্যাপক নাসরীন।
“এটি যে নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ, তা না। এটি আসলে রাষ্ট্রে চলমান লিঙ্গীয় রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ির বহিঃপ্রকাশ। রোকেয়া কোনও একক ব্যক্তি না, তিনি নারী জাগরণের প্রতীক। সেক্ষেত্রে গ্রাফিতিতে কালি লেপনের মতো আচরণ পুরোপুরি নারী বিদ্বেষী অবস্থান।”
এটিকে “ঘৃণাযুক্ত সাহস” হিসাবে সঙ্গায়িত করে তিনি আরও বলেন যে এভাবে কালিমা লেপনের অর্থ হলো নারী জাগরণের সকল ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা।
তিনি বলেন গত পাঁচই অগাস্টের পর “বিভিন্ন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, মাজারের ওপর আক্রমণ, বাউলদের হেনস্থা করা, নারীর প্রতি সহিংসতা…চলছে। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এর শিকার হয়েছি।”
এই যা কিছু হচ্ছে, তা দিনশেষে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারও বহিঃপ্রকাশ। “পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পুরুষই লালন করে না, নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা লালন করে,” যোগ করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ বিশ্লেষক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এই আলোচনায় আরও কিছু বিষয় যোগ করেন। তার মতে, “এই মেয়েটা একদিনে হুট করে এই কাজ করেনি।”
“তার মাঝে এই মন্তস্তত্ত্ব তৈরি করা হয়েছে। যেমন– ওয়াজগুলোতে লাগাতর নারীর প্রতি হেট স্পিচ ব্যবহার করা হয়। সেখানে বেগম রোকেয়ার নামও বহুবার এসেছে। যারা খুবই প্রতিষ্ঠিত, তাদের ওয়াজেও এসেছে। ওই যে হেটস্পিচ যখন তৈরি হয়, তখন তা জনমনে ছড়ায়।”
তিনি মনে করেন, এই ধরনের হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক কথার বিপরীতে আইন হওয়া জরুরি।
বেগম রোকেয়ার ছবিতে কালি দেওয়ার ঘটনায় মিডিয়া’র ভূমিকা দেখে “অবাক, বাকরুদ্ধ ও লজ্জিত” বোধ করেছেন জাবি’র এই শিক্ষক। তার মতে, “বেগম রোকেয়ার নাম পরিবর্তন করতে চাওয়া, তার ছবিতে এগুলো করা– ভীষণভাবে কাভার করা উচিৎ ছিল।”
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিনের মতো অধ্যাপক রেজওয়ানা করিমও মনে করেন যে গত পাঁচই অগাস্টের পর এগুলো বেড়েছে। “বর্তমান সরকার নির্বাচিত না। এখন নিরাপত্তা খুবই ভঙ্গুর। আমার মনে হয়, এই যে দুর্বল জায়গা আছে, সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী।”
আর, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করেন। তার মতে, নাম পরিবর্তনের মতো অযাচিত দাবি উত্থাপন করার পেছনেও রাজনীতি আছে।
“জুলাই আন্দোলনে প্রচুর মেয়ে ছিল। মেয়েরা না থাকলে এত জোরদার হতো না আন্দোলন। কিন্তু মিডিয়া হাউজগুলো এটিকে ছাত্র-জনতা বানিয়ে দিল। আপনি শব্দের মধ্য দিয়ে মেয়েদেরকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। ভাষা থেকে বাদ দেওয়া মানে তার অবদানকে বাদ দেওয়া।”
উপদেষ্টা পরিষদে বা প্রধান উপদেষ্টা যখন কথা বলেন, তার আশেপাশেও নারীদের উপস্থিতি কম। “এভাবেই নারীকে সাইডলাইন করা হচ্ছে। বেগম রোকেয়ার ইস্যুটার মূলেও এগুলোই।”
বেগম রোকেয়া
বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন– বেগম রোকেয়া হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ‘-এর আয়োজন করে। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আসেন বেগম রোকেয়া।
ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে লড়াই করে বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার বিস্তার করেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের নয়ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল।
সেসময় তাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনও চল ছিল না। আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোনও সুযোগ ছিল না।
শিশু বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের সময় তিনি লেখাপড়ার যে সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন, তা সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের সমালোচনায় বেশিদূর এগোতে পারেনি, যদিও ভাইবোনদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি অল্প বয়সেই আরবী, ফারসি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত করেছিলেন।
বিহারের ভাগলপুরে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর তার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল। স্বামীর সহায়তায় তিনি আরও পড়াশুনা করেন এবং পরে সাহিত্যজীবন শুরু করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর লেখালেখির বাইরে সমাজে বদল এবং নারীশিক্ষার বিস্তারে কাজ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের তৎকালীন অধ্যাপক সোনিয়া আনিম তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “নারী হিসাবে মেয়েরা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তারা সেখানে পৌঁছতেন না, যদি নারীর উন্নতির জন্য বেগম রোকেয়ার মতো মনীষীর অবদান না থাকতো।”
“আমরা আজ এখানে থাকতাম না, যদি রোকেয়া ওইসময় ইনিশিয়েট না নিতেন। এটিকে অস্বীকার করার সুযোগই নাই। নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারার গভীরতম উৎস বেগম রোকেয়া,” বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।