প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতনি, মাওলা আলী (রা.) এবং মা ফাতিমা (রা.)-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা, সৈয়দা জয়নব বিনতে আলী (রা.)।
তিনি সেই মহীয়সী নারী যিনি তার ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞার কারণে হয়ে আছেন চিরস্মরণীয়। মা জয়নব (রা.) সেই নারী যিনি কারবালার দুঃসহ কষ্ট সয়ে সামলে রেখেছেন তার পরিবারের বেঁচে যাওয়া নারী-শিশুসহ শোকে মুহ্যমান প্রতিটি সদস্যকে। স্বৈরাচারী এজিদ ও ইবনে জিয়াদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন অসুস্থ কিশোর ইমাম আলী জয়নুল আবেদীন (রা.)কে। এক অর্থে সৈয়দ বংশকে, তার বচন থেকেই পৃথিবী শুনেছে কারবালার যুদ্ধের নির্মম বর্ণনা এবং যুদ্ধের আদর্শগত সত্য-মিথ্যার প্রভেদ নারী।
তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি কারবালার যুদ্ধে তথাকথিত বিজয়ে আত্মহারা ক্ষমতাসীন এজিদকে তারই পরিষদে দাঁড়িয়ে লজ্জিত ও হেয় করেছেন। অনেকেই বলেন, নবী পরিবারের মহীয়সী নারীরা গোপন থাকতে পছন্দ করতেন, ইবাদতেই মশগুল থাকতেন। মা খাদিজা, মা আয়েশা, মা ফাতিমা (রা.) তাদের সম্পর্কেও কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে মা জয়নব (রা.) সম্পর্কে আমরা এত কম জানি কেন? কারণ তিনি সেই নারী যিনি তার পিতার মতোই সত্য ও মিথ্যার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। আহলে বায়েত (আ.)কে ধারণ করেছেন। খারেজিদের চিহ্নিত করেছেন। দুনিয়ার সামনে কারবালার যুদ্ধের আদর্শগত ও বাস্তবিক সত্য তুলে ধরেছেন।
তার মৃত্যুর পরও ক্ষমতায় উমাইয়ারাই ছিল। যাদের মনে তিনি তখনই আতঙ্কের সঞ্চার করেছিলেন। তাই ক্ষমতাসীনদের কূটরাজনীতির খেলায় সৈয়দা জয়নব বিনতে আলী (রা.) সম্পর্কে পাওয়া তথ্য অপ্রতুল। যেহেতু তার বক্তব্যগুলো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে পাওয়া; তাই গবেষকরা পরিবার ও কারবালা সম্পর্কে তার দেয়া বক্তব্য থেকেই তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
মদিনা শরিফে হিজরতের পাঁচ বা ছয় বছর পর, মা ফাতিমার (রা.) কোল আলো করে জন্ম নেন সৈয়দা জয়নব বিনতে আলি (রা.)। তারিখ ছিল মতভেদে ৫ জমাদিউল আউয়াল অথবা ১ শাবান। রাসূলুল্লাহ (সা.) সে সময় মদিনা শরিফে ছিলেন না, তাই তখনও সদ্য জন্ম নেয়া কন্যার কোনো নাম তারা রাখেননি। নবীজি (সা.) ফিরে এলে শিশু মা জয়নবকে (রা.) তাঁর সামনে আনা হল। তিনি তাকে তাঁর পবিত্র কোলে নিলেন এবং আদর করে চুমু দিলেন।
সে সময় জিবরাইল (আ.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। নবীজি (সা.) কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! জীবনের প্রথম থেকেই এ কন্যা কঠোর যন্ত্রণা এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বড় হবে। প্রথমে সে আপনার সঙ্গে বিচ্ছেদের দুঃখ পাবে, এরপর কষ্ট পাবে একে একে তার মাতা ও পিতার মৃত্যুর, অতঃপর তার বড় ভাই হজরত হাসানের (রা.) মৃত্যুর। এসব কিছুর পরও তিনি কারবালার কঠিন যন্ত্রণার মুখোমুখি হবেন। যার ফলে তার চুল ধূসর হয়ে যাবে এবং পিঠ বেঁকে যাবে।’ এবার নবীজি (সা.) এবং অন্যান্য সবাই কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর নানাজান নবীজি (সা.) তার নাম দিলেন ‘জয়নব’, যার অর্থ ‘পিতার অলঙ্কার বা সৌন্দর্য’।
শিশু জয়নব (রা.) যখন কান্না করতেন তখন ভাই হোসাইন (রা.) কোলে নিলে তিনি শান্ত হয়ে যেতেন এবং এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বড় হওয়ার পরও প্রগাঢ় ভালোবাসার দরুন কোনো ইবাদত শুরু করার আগে তিনি ভাই হোসাইন (রা.) দিকে আগে এক পলক দেখে নিয়ে পরে নামাজ ও ইবাদত শুরু করতেন। মা জয়নবের (রা.) বয়স যখন ছয় বা সাত, তখন তার প্রিয় নানাজান রাসূলুল্লাহ (সা.) কে হারান। এর কিছুদিন পর মাতা হজরত ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেন।
দুঃখে ভারাক্রান্ত ছোট্ট শিশু জয়নব (রা.) সে বয়স থেকেই রীতিমতো সংসার সামলানো শুরু করেন। ফলে পিতা, বোন উম্মে কুলসুম (রা.) এবং ভাইদ্বয়ের সঙ্গে তার আবেগময় টানের সম্পর্ক প্রবলতর হতে থাকে। বড় হয়ে এ কাজের পাশাপাশি তিনি মদিনা শরিফের নারীদের কোরআন শিক্ষা দিতেন।
তিনি নিজে ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়ী নারী। পাঠদানের সাবলীলতা ও পদ্ধতির কারণে তার প্রশংসা নারীমহলে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই তাকে বলা হতো ‘ফাসিহাহ্’ (কৌশলী বক্তা) এবং ‘বালিগাহ’ (দুর্দান্ত বাকপটু); অর্থাৎ পিতার অলঙ্কার হওয়ার সব বৈশিষ্ট্যই তিনি ধারণ করেছিলেন। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক
সূত্র: যুগান্তর