ছবির উৎস, Getty Images
অবশেষে বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলো গাজায় বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
গাজায় গত ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তীব্র লড়াই চলার পর অবশেষে যুদ্ধরত পক্ষগুলো বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
গত ৭ই অক্টোবর থেকে হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ জনকে মুক্তি দেয়ার কথা রয়েছে এই চুক্তিতে।
এর বিনিময়ে গাজায় চার দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে মুক্তি দেওয়া হবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, যে ৫০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে তারা সবাই নারী ও শিশু।
যুদ্ধবিরতি চার দিনেরও বেশি সময় ধরে চলতে পারে বলে তারা জানিয়েছেন।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রথম ৫০ জনকে মুক্তি দেয়ার পর প্রতি ১০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হলে একটি অতিরিক্ত দিন যুদ্ধবিরতি থাকবে বা যুদ্ধবিরতি এক দিন বাড়ানো হবে ।
জিম্মিদের স্বজনরা বিবিসিকে জানিয়েছে যে তারা এমন কোন আংশিক চুক্তি চায় না যেখানে শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
তবে এই ধারাটি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাকি জিম্মিরা মুক্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম ৫০ জনের মধ্যে যাদের মুক্তি দেওয়া হবে তাদের বেশিরভাগই ইসরায়েলি নাগরিক যাদের দুই দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে যে তারা হামাসের হাতে জিম্মি ৫০ জন ইসরায়েলি নাগরিককে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে। এ জন্য চারদিন যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।
ছবির উৎস, Reuters
গাজায় এখনও হামলা অব্যাহত রয়েছে।
এই সংঘাতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে আসছে কাতার। এর আগেও হামাসের হাতে জিম্মি চারজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র কাতারের মধ্যস্থতায়।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, কাতারি কর্মকর্তারা বুধবার সকালে ইসরায়েলের কাছে চুক্তির প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি সরকার যে চুক্তিটি পর্যালোচনা করছে তাতে বলা হয়েছে যে কয়েক দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধের বিনিময়ে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা হামাসের সঙ্গে এই জিম্মি চুক্তি অনুমোদনের পক্ষে ভোট দেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে।
ওই বিবৃতিতে বলা হয় “ইসরায়েল সরকার সকল জিম্মিকে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। “
“সরকার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথম পর্যায়ের রূপরেখা অনুমোদন করেছে, সে অনুযায়ী নারী ও শিশুসহ ৫০ জন জিম্মিকে চার দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে, ওই সময়ে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।”
“ইসরায়েলি সরকার, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা পরিষেবা সমস্ত জিম্মি দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত এবং হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।”
“এটি নিশ্চিত করা হবে যে গাজায় ইসরায়েলের জন্য নতুন কোনো হুমকি নেই।”
ছবির উৎস, Reuters
কাতার হামাস ও ইসরায়েলি দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে আসছে।
ফিলিস্তিনিদের মুক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরায়েল
ইসরায়েল ৩০০ ফিলিস্তিনিদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যারা ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে হওয়া চুক্তির অধীনে মুক্তি পেতে পারে।
ইসরায়েলের আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা তালিকায় তাদের নাম, বয়স এবং বন্দি করার কারণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তবে প্রাথমিকভাবে ১৫০জন বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবিসিকে জানিয়েছে যে ইসরায়েলের হাতে অন্তত ৭০০০ ফিলিস্তিনি বন্দি অবস্থায় আছে।
যার মধ্যে অন্তত দুশোজন নারী, এছাড়া প্রায় ৬০টি শিশু রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকল্প পরিচালক সারি বাশি নিউজ আওয়ার প্রোগ্রামকে বলেছেন, কিছু শিশুকে “পাথর নিক্ষেপের মতো তুলনামূলকভাবে লঘু” অপরাধের জন্য আটক করা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, “এই ফিলিস্তিনি শিশুদের সামরিক আইনের অধীনে মধ্যরাতে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
“তাদেরকে বাবা-মা বা আইনজীবীর উপস্থিত ছাড়াই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত লঘু অপরাধের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে”।
এদিকে গাজায় এখনও লড়াই অব্যাহত রয়েছে, হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে ইসরায়েলের অভিযানে এ পর্যন্ত ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন – যার মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিশু।
ছবির উৎস, Getty Images
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
জিম্মিদের মুক্তির পরও গাজায় যুদ্ধ চলবে: নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।”
ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি বিষয়ে চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগে একটি রেকর্ড করা ভিডিও বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হলেই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে এই কথা বলা “বোকামি”।
তিনি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনাকে তার ‘সবচেয়ে বড় লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন- “যুদ্ধের অনেক পর্যায় আছে এবং জিম্মিদের ফেরার অনেক পর্যায় থাকবে, কিন্তু আমরা পুরোপুরি জয়ী না হওয়া পর্যন্ত থামব না। সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা আমাদের সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্ব।”
তিনি বলেন, হামাসকে নির্মূল করাও একটি লক্ষ্য এবং গাজায় এমন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যা আবার ইসরাইলকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন যে তিনি “এই চুক্তির পরিকল্পনা করতে সহায়তা করেছিলেন।”
ছবির উৎস, Getty Images
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
চুক্তি নিয়ে কী বললেন জো বাইডেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি বিষয়ক চুক্তি প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি এতে ‘খুবই সন্তুষ্ট’। কয়েক সপ্তাহ ধরে জিম্মি হওয়া এই লোকেরা অবশেষে তাদের পরিবারের সাথে দেখা করবে।
এই চুক্তির ফলে ‘গাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর দুর্ভোগ লাঘব হবে’ বলেও বাইডেন জানান।
যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি গাজায় আরও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেন তিনি।
বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, “চুক্তির প্রতিটি বিষয় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে জরুরি।”
এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেই সাথে কাতার ও মিশরও মধ্যস্থতা করেছে।
এই চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালনের জন্য কাতার এবং মিশরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাইডেন।
ছবির উৎস, Getty Images
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ
হামাস কী বলছে?
এই চুক্তির বিষয়ে হামাস একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, ৫০ জন ইসরায়েলি জিম্মির বিনিময়ে ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
কয়েক সপ্তাহের আলোচনার পর, ইসরায়েল এবং হামাস সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিল যে উভয় পক্ষই হামাসের হেফাজতে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের বিষয়ে একটি চুক্তির খুব কাছাকাছি রয়েছে।
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ মঙ্গলবার রয়টার্সকে বলেছিলেন, হামাস ইসরায়েলের সাথে একটি ‘যুদ্ধবিরতি চুক্তির’ খুব কাছাকাছি রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও বলেছেন যে শীঘ্রই ‘সুসংবাদ’ দেয়া হবে।
এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার জন্য হামাসও কাতার ও মিশরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
ছবির উৎস, Reuters
আল-শিফা হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছেছে।
চুক্তিতে কী বলা আছে?
এই চুক্তির আওতায় মানবিক সাহায্য, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও জ্বালানি ভর্তি শত শত ট্রাক গাজায় প্রবেশ করবে।
হামাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চারদিনের যুদ্ধবিরতি চলাকালে ইসরায়েল কোনো হামলা চালাবে না বা কাউকে গ্রেফতার করবে না।
চার দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়, স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দক্ষিণ গাজায় এবং উত্তর গাজায় প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা বিমান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে।
৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস হামলা চালানোর পর অন্তত ২৪০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র চারজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
কাতার, যারা চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছে তারা এক বিবৃতিতে জানায়, “যুদ্ধবিরতি শুরুর সময় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণা করা হবে। এই যুদ্ধ বিরতি তারপর চার দিন স্থায়ী হবে”।
এদিকে গাজার সবচেয়ে বড় আল-শিফা হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছেছে।
প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) এই তথ্য জানায়।
প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর গত সপ্তাহে ইসরায়েল গাজা সিটির এই হাসপাতালটি দখল করে, সে সময় শত শত রোগী ও কর্মচারী ভিতরে আটকা পড়ে।
পরে বেশিরভাগ রোগী সেখান থেকে সরে গেলেও গুরুতর অসুস্থ প্রায় ৩০০ রোগী এবং কয়েকজন চিকিৎসক সেখানেই থেকে যান।