ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশে ঈদ উদযাপিত হবে বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশে প্রতি বছরই রমজানের শেষ দিকে কিছু বিতর্ক জোরালো হতে শুরু করে। তার অন্যতম চাঁদ দেখা ও ঈদের দিন নির্ধারণ।
এবারও তেমন বিতর্কে নেমেছেন সামাজিক মাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারী। নিজেদের অবস্থানের পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি দিতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পালনে চাঁদ দেখার ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন উঠে আসছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার কয়েকটির উত্তর খোঁজা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
খালি চোখেই চাঁদ দেখতে হবে?
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর সাধারণত প্রতি মাসেই তাদের ওয়েবসাইটে পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের স্থানাঙ্ক জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে।
গত বছরের এপ্রিলে হিজরি শাওয়াল মাসের চাঁদের দিনক্ষণ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরদিন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তরফে আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
সেই বিজ্ঞপ্তিতে চাঁদ দেখা নিয়ে ‘অগ্রিম, বিভান্তিকর ও এখতিয়ার বহির্ভূত’ সংবাদ প্রকাশে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে অনুরোধ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, এই এখতিয়ার শুধু জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির রয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের জন্য তারা কেবল মাত্র খালি চোখে চাঁদ দেখার ওপরই নির্ভর করে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারণের জন্য ভূখণ্ড থেকে চাঁদ দেখা কমিটির নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে স্বচক্ষে চাঁদ দেখতে হবে।
কিন্তু যেখানে বৈজ্ঞানিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে দিনটি সম্পর্কে আগেভাগেই নিশ্চিত জোতির্বিজ্ঞানীরা, সেখানে শেষ দিন পর্যন্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা কেন- এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
ছবির উৎস, Getty Images
নতুন চাঁদ
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মোহাম্মদ রুহুল আমীনের মতে, হাদীস অনুযায়ীই খালি চোখে চাঁদ দেখাকে প্রাধান্য দেয়া হয় ধর্মীয় উৎসব নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
“নিজের চোখে দেখে রোজা রাখা শুরু করা এবং ঈদ উদযাপন করার উপদেশ দেয়ার স্পষ্ট হাদীস রয়েছে। আরও বলা হয়েছে কোনো কারণে চাঁদ দেখা না গেলে – যেমন, চাঁদ উঠলো কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় দেখা গেলো না– সেক্ষেত্রে ত্রিশ দিন মিলিয়ে ঈদ পালন করতে।”
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইয়েদ আব্দুল্লাহ-আল-মারুফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “খালি চোখে দেখার নির্দেশনা যখন দেয়া হয়েছিল সেই সময় মুসলমানরা নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিলেন। সেখানকার কেউ শাওয়াল চাঁদ দেখলে সেই তথ্য ঘোড়ায় চেপে যতদূর প্রচার করা যেত সেই এলাকা পর্যন্ত ঈদ উদযাপিত হতো।”
এখন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে আছেন। প্রযুক্তির বদৌলতে যেকোনো জায়গায় বার্তা পৌঁছে দেয়াও সহজতর হয়েছে।
এসব কারণ উল্লেখ করে অধ্যাপক মারুফ বলছেন, সর্বত্র একদিনে চাইলে ঈদ করা যেতে পারে।
ছবির উৎস, Getty Images
দিল্লিতে ঈদের জামাত
সৌদি আরবের পরদিনই কেন বাংলাদেশে ঈদ?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো কোনো ব্যবহারকারীকে প্রশ্ন করতে দেখা গেছে, “সৌদি আরবের পরদিন বাংলাদেশে ঈদ হলে, জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির কাজটা কী?”
এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি সৌদি আরবের পরদিনই চাঁদ দেখা যাবে?
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সূর্যের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়ে থাকলেও হিজরি ক্যালেন্ডারে মাসের হিসাবটা হয় চাঁদের আবর্তনকে অনুসরণ করে।
ভৌগোলিকভাবে পশ্চিমে অবস্থিত হওয়ায় আরব বিশ্বে বাংলাদেশের তিন ঘণ্টা পর সূর্যাস্ত হয়। সেটা সূর্যের হিসাব। কিন্তু চাঁদের হিসাব অন্যরকম।
কারণ চাঁদ যে গতিতে পৃথিবীর চারদিকে পরিভ্রমণ করে, পুরো পৃথিবী ঘুরতে ২৯.৫ দিন লাগে।
আবার বাংলাদেশ থেকে পূর্বদিকের দেশগুলো সূর্য আগে দেখতে পেলেও পশ্চিমের দেশগুলো চাঁদ আগে দেখতে পায়।
ফলে সূর্যের হিসাবে সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য তিন ঘণ্টা হলেও চাঁদের হিসাবে সেটা ১৭ থেকে ২১ ঘণ্টার।
খালি চোখে চাঁদ দেখার মতো উপযোগী হতে চাঁদ ও সূর্যের মধ্যবর্তী কোণ পৃথিবী থেকে ১০.৫ ডিগ্রিতে থাকতে হবে। সেই অবস্থানে নতুন চাঁদের যেতেও এই সময় লাগে। ফলে নতুন চাঁদের জন্ম হলেও খালি চোখে বাংলাদেশ থেকে দেখা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি মুনির হাসান বলেন, “নতুন চাঁদের জন্ম হওয়ার পরে সময়ের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আকাশে তার উপস্থিতি বাড়তে থাকে।”
“মঙ্গলবার বাংলাদেশের দিগন্ত রেখার ওপরে নতুন চাঁদের উদয় হয়েছিল বটে। কিন্তু, এত কম অংশ আলোকিত ছিল যে খালি চোখে দেখা সম্ভব হয়নি,” যোগ করেন তিনি।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, এর স্থায়িত্ব ছিল ১২ মিনিটের মতো।
“টেলিস্কোপ নিয়ে দিক, কোণ নির্ধারণ করে কেউ দেখতে চাইলে হয়তো দেখতে পেত,” বলেন মি. হাসান।
আবার সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া আরব বিশ্বের মতো করেই ঈদ পালন করে। তাদের অনুসরণ করে আফ্রিকার কিছু মুসলিম দেশও। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের মুসলমানরা সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে রোজা ঈদ পালন করে।
আবার অস্ট্রেলিয়ায় একটি অংশ সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ করলেও অন্য অংশটি চাঁদ দেখে ঈদ পালন করে।
ছবির উৎস, Getty Images
টেলিস্কোপে আকাশে ঈদের চাঁদ দেখার চেষ্টা করছেন মালয়েশিয়ার এক মুসলিম
কোন পদ্ধতি সঠিক
কোন পদ্ধতি সঠিক, তা নিয়ে মুসলিম দেশগুলোয় বিতর্ক রয়েছে। অনেক দেশে মুসলমানদের মধ্যে দুই ধরনের রীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়।
তবে বেশিরভাগ মুসলিম দেশে ঈদের তারিখ সরকারিভাবে নির্ধারিত হয়।
অনেক দেশে চান্দ্র বর্ষপঞ্জি আগে থেকে নির্ধারিত করা থাকে। ফলে ঈদের তারিখটি আগে থেকেই জানা যায়।
২০১৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল তুরস্কের উদ্যোগে। সেখানে তুরস্ক, কাতার, জর্ডান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরোক্কোসহ ৫০টি দেশের ধর্মীয় পণ্ডিত এবং বিজ্ঞানীরা অংশ নেন।
ইন্টারন্যাশনাল হিজরি ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে পরিচিত এই সম্মেলনে হিজরি ক্যালেন্ডার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের মধ্যে যে বিভক্তি সেটা নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সেখানে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই বিশ্বের মুসলিমদের একটি বর্ষপঞ্জি মধ্যে নিয়ে আসার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন।
আর সেটি হলে রোজা যেমন একই দিন থেকে শুরু হতো তেমনি ঈদও একই দিন পালন করা সম্ভব হতো। কিন্তু সব মুসলিম দেশ সেটা কার্যকর করেনি।
ছবির উৎস, Getty Images
সব বয়সী মুসলমান শামিল হন ঈদের নামাজে
তবে, বাংলাদেশে বহু ধর্মীয় নেতা এখনো পর্যন্ত নিজ দেশে খালি চোখে চাঁদ দেখা যাওয়ার ওপরই নির্ভর করতে চান।
কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম আকবর হোসেন বলছেন, ঈদের বিষয়ে যে শরিয়াহ বোর্ড সরকারকে পরামর্শ দেয় তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হলে জনমনে বিভ্রান্তি হবে না বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানী এবং ইসলাম ও বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক ড. শমসের আলী।
ড. আলীর বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্ধারণের জন্য ইসলামে যে বিধান আছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই আধুনিক জ্যোর্তিবিজ্ঞান প্রয়োগ করে খুব সহজেই বলে দেয়া সম্ভব কখন হিজরি সনের নতুন চান্দ্র মাস শুরু হচ্ছে।”