ছবির উৎস, Getty Images
আগারগাঁও থেকে মতিঝিল মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে শনিবার। এর ফলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হলো।
বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা শুরু হচ্ছে রবিবার থেকে। এতদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু থাকলেও এখন মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে।
এর মাধ্যমে কার্যত মেট্রোরেলে সেবা পুরোদমে শুরু হতে যাচ্ছে।
শনিবার এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে যাত্রীরা এই সেবা ব্যবহার করতে পারবেন রবিবার থেকে।
আপাতত কিছুদিন প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে চার ঘণ্টা করে আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে ট্রেন চলবে। এই সময় ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সবগুলো স্টেশন খুলে দেয়া হবে এবং ট্রেনের সময় সীমা বাড়বে।
নকশাগত ত্রুটি, কোভিড মহামারি, হোলি আর্টিজান হামলায় জাপানি প্রকৌশলীদের মৃত্যুসহ বিভিন্ন কারণে কয়েক দফা পিছিয়েছে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ। নানা কারণে বেড়েছে নির্মাণ ব্যয়ও।
তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট -৬ বা এমআরটি -৬ হিসেবে পরিচিত মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হওয়ার ফলে যানজটের নগরী হিসাবে পরিচিত ঢাকার ভেতরে নিয়মিত যাতায়াত করা লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য নিশ্চিতভাবেই স্বস্তি আনতে যাচ্ছে।
চলুন জেনে নেই ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের কিছু খুঁটিনাটি।
ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধন করেছিলেন
নির্মাণ ব্যয়
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-৬ নির্মাণের প্রকল্প যখন হাতে নেয়া হয়, তখন এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কাউন্সিল, একনেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্প অনুমোদন করে। এরপর ২০১৬ সালের জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রকল্পের এক চতুর্থাংশ অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি টাকার যোগান দিয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা, জাইকা।
প্রথমে ২০২০ সালের মধ্যে এটি শেষ করার পরিকল্পনা করা হলেও পরবর্তীতে এর কাজ শেষ হওয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এর মধ্যে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেল নির্মাণের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন জাপানি নাগরিক মারা যায়। এই কারণে কিছুদিন বন্ধ ছিল প্রকল্পের নির্মাণকাজ। কোভিড মহামারির জন্যও বিলম্বিত হয় প্রকল্পের কাজ।
শুরুতে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছর নির্মাণের ব্যয় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
প্রথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির লক্ষ্য থাকলেও পরে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরো দেড় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে এর খরচ বাড়ে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার কোটি টাকা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এমআরটি-৬ লাইনের সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অবশ্য মনে করেন মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হকের মতে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় লাগে, যার প্রভাব পড়ে প্রকল্পের খরচে।
ছবির উৎস, Getty Images
এশিয়ার মধ্যে ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয়েছে বাংলাদেশে
এশিয়ার কততম দেশ?
এশিয়ার মধ্যে ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয়েছে বাংলাদেশে।
বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে শহরের ভেতরে গণপরিবহন হিসাবে মেট্রোরেলের মত সেবা চালু রয়েছে। এলাকাভেদে এগুলো মেট্রোরেল, সাবওয়ে, ইউ-বান সহ বিভিন্ন নামে পরিচিত।
বিশ্বে প্রথম মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয় লন্ডনে, ১৮৬৩ সালে। আর এশিয়ায় প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় জাপানের টোকিও শহরে ১৯২৭ সালে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মেট্রোরেল সেবা রয়েছে চীনে। চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের একাধিক শহরে মেট্রোরেল সেবা রয়েছে।
ছবির উৎস, Getty Images
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মোট ১৭টি স্টেশনে থেমে এই ২১.২৬ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে মেট্রোরেলের মোট সময় লাগবে ৪০ মিনিট
দৈর্ঘ্য কত? কত সময় লাগবে?
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি-৬ এর মোট দৈর্ঘ্য ২১.২৬ কিলোমিটার। বলা হচ্ছে এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মোট ১৭টি স্টেশনে থেমে এই ২১.২৬ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে মেট্রোরেলের মোট সময় লাগবে ৪০ মিনিট।
দৈর্ঘ্য ও গতি – দুই হিসেবেই বিশ্বের শীর্ষ মেট্রোরেল চীনের সাংহাই মেট্রো। এই রেল নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৩২ কিলোমিটার।
আর এই মেট্রো সিস্টেমের সাংহাই মাগলেভ ট্রেনটির গড় গতি ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার ও সর্বোচ্চ গতি ৪৩১ কিলোমিটার পর্যন্ত।
সাংহাই সাবওয়ে লাইন ২’এ চলাচল করা এই ট্রেনটি যেই রুটে নিয়মিত চলাচল করে সেখানে ৩০ কিলোমিটার যেতে এটি সময় নেয় ৮ মিনিট।
ছবির উৎস, Dhaka Mass Transport Company Limited
কত যাত্রী বহন করতে পারবে?
সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে মেট্রোরেলে ট্রেন চলাচল করবে ২৪টি। এই ট্রেনগুলোতে ৬টি করে কোচ থাকবে।
তবে এই কোাচের সংখ্যা পরবর্তীতে যেন ৮টি করা যায়, সেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে এটির।
প্রতিটি ট্রেনে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩০৮ জন করে।
সেই হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় মেট্রোরেল ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে যাওয়া আসা করতে পারবেন ছয় লাখ ৭৭ হাজার মানুষ।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০২৬ সালে দৈনিক যাত্রী চলাচলের সংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৮৩ হাজারে এবং তা ২০৫১ সালে বেড়ে দাঁড়াবে দৈনিক ১৩ লাখে।
যাত্রী বহনের সক্ষমতার দৈনিক হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি যাত্রী বহন করে জাপানের টোকিওর সাবওয়ে। তিনশো কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এই সাবওয়ে দৈনিক যাত্রী বহন করে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষ।
ছবির উৎস, Dhaka Mass Transport Company Limited
প্রতি ঘণ্টায় মেট্রোরেল ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে
ভাড়া কত?
মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা আর সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা।
গত বছর ডিসেম্বরে চালু হয় মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৬০ টাকা ভাড়ায় যাতায়াত করেছেন মানুষ।
ঢাকার যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের ভাড়ার যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সে হিসেবে উত্তরা-উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা।
পল্লবী থেকে মতিঝিলের ভাড়া ধরা হয়েছে ৮০ টাকা ও ফার্মগেট থেকে মতিঝিলের ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০ টাকা।
আর সচিবালয় থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া ধরা হয়েছে ২০ টাকা। তার মানে সর্বনিম্ন দূরত্ব ভ্রমণ করলে – অর্থাৎ এক স্টেশন থেকে পরের স্টেশনে গেলে – ভাড়া ধরা হয়েছে ২০ টাকা।
ছবির উৎস, Getty Images
চীনের সাংহাই মেট্রো পৃথিবীর দীর্ঘতম মেট্রোরেল
যানজট কমাবে?
সড়ক মহাসড়ক বিভাগের হিসেব অনুযায়ী গত এক দশকে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যোগাযোগের নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য।
কিন্তু তারপরও এ বছরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক জরিপে উঠে আসে যে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। ১৫২টি দেশের ২০০টিরও বেশি শহরের যান চলাচলের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয় ঐ জরিপটি।
মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হলে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকার মানুষ তীব্র যানজট থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে যে গত ১০ মাসে মেট্রোরেলে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেছেন তাদের প্রায় ৬০ ভাগই এতদিন বাসে যাতায়াত করতেন।
এ কারণে মেট্রোরেল চালু হলে রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমবে এবং তা যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ছবির উৎস, Dhaka Mass Transport Company Limited
মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা আর সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা।
আরো যত মেট্রোরেল
ঢাকায় এমআরটি লাইন ৬ এর পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে আরো পাঁচটি মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
এমআরটি লাইন – ১ এর রুট বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এবং বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেল হওয়ার কথা এটির।
এর পাশাপাশি সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গুলশানের ভাটারা পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি লাইন-৫: নর্দার্ন রুটের নকশার শেষ পর্যায়ের কাজ চলমান রয়েছে।
এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত, গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ও কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আরো তিনটি মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে।