ছবির উৎস, shutterstock
হামাসের আকস্মিক হামলার জবাবে গাজা উপত্যকায় পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী
হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ শুরু করার আগে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
গাজা উপত্যকার সাতটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকার নাগরিকদের নিজেদের ঘর থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। তারা জানিয়েছে যে সেসব এলাকায় হামাসের ঘাঁটি রযেছে, সেখানে নতুন হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে তারা।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামলার সতর্কতা আসার পর গাজার নাগরিকদের অনেকে এরই মধ্যে তাদের ঘর ছেড়ে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
প্রতিশোধের হুমকি দিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার সবশেষ ভিডিও বার্তায় বলেছেন যে তাদের ‘শত্রুকে এর চূড়ান্ত মূল্য দিতে হবে, যা তাদের আগে কখনো দিতে হয়নি।’
এই হামলাকে ‘অপারেশন আল-আকসা স্টর্ম’ হিসেবে বিবৃত করেছেন হামাসের শীর্ষ কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন যে, “আমরা শত্রুদের এর আগেই সতর্ক করেছি। তারা শত শত বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে। তাদের অপরাধের জন্য শত শত মানুষ শহীদ হয়েছে।”
ছবির উৎস, Reuters
ফিলিস্তিন থেকে হামাস এখন পর্যন্ত অন্তত ৭ হাজার রকেট ছুঁড়েছে ইসরায়েলের দিক
শনিবার সারা রাত ধরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ২২টি স্থানে হামাসের সাথে ইসরায়েলি সেনাদের সংঘর্ষ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দুটি জায়গায় ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মি করে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ।
কয়েকটি জায়গায় জিম্মি হয়ে থাকা ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্ত করার খবরও জানাচ্ছে তারা।
হামলার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর কিব্বুতজ বে’এরি অঞ্চলের একটি খাবার ঘরে জিম্মি করে রাখা নাগরিকদের মুক্ত করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম।
গাজা উপত্যকা সংলগ্ন সীমানায় দুই পক্ষের লড়াইয়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডারও নিহত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
হামাসের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন যে ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা করার পেছনে তাদের সহযোগী ইরানের সহায়তা রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শনিবার সন্ধ্যায় সামাজিক মাধ্যম এক্স’এ – কিছুদিন আগে যেটি টুইটার নামে পরিচিত ছিল – পোস্ট করা এক ভিডিওতে বলেছেন যে ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি।’
ঐ ভিডিওতে ‘ফিলিস্তিনের জঙ্গিদের’ বিরুদ্ধে ‘ভয়াবহ প্রতিশোধ’ নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। এটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন মি. নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও একই ধরণের মন্তব্য করেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন: “হামাস অত্যন্ত বড় একটি ভুল করেছে। তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।”
‘ইসরায়েল রাষ্ট্র’ এই যুদ্ধে ‘বিজয়ী হবে’ বলেও তার বিবৃতিতে দাবি করেছেন তিনি।
আকস্মিক এই হামলার পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে জানায়নি হামাস। তবে গোষ্ঠীটির কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ বলেছেন যে তাদের সেনারা মনে করেছে ‘এনাফ ইজ এনাফ’, অর্থাৎ ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর না।’
শনিবার হামলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর হামাসের শীর্ষ এই কমান্ডার বলেছিলেন যে প্রাথমিক দফায় ৫ হাজার রকেট ছোঁড়া হয়েছিল। এরপর শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আরো দুই হাজার রকেট ছোঁড়া হয়েছে বলে জানায় হামাস টিভি।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, দখলদার সৈন্য এবং সেটলাররা যে আতঙ্ক তৈরি করেছে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার রয়েছে নিজেদের রক্ষা করার।
ছবির উৎস, EPA
এখন পর্যন্ত হওয়া সংঘর্ষে দুই দিকে প্রায় ৫০০ মানুষ মারা গেছে বলে জানা যাচ্ছে
শনিবার ফিলিস্তিনের দিক থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক রকেট হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন ইসরায়েলি নাগরিক মারা গেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ। শতাধিক মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে বলেও বলছে তারা।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ফিরতি আক্রমণে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৩২ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
শনিবার সন্ধ্যা থেকেই গাজা উপত্যকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিসের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে যে ইসরায়েল গাজায় খাবার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০০৭ সাল থেকে মিসর ও ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় চলাচল ও প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
গাজার উপরের বিমান চলাচলের পথ ও গাজা উপত্যকা সংলগ্ন উপকূল নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
গাজা ভূখণ্ডের একদিকে প্রবেশে ও পণ্য চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল, অন্য দিকে নিয়ন্ত্রণ করে মিশরের কর্তৃপক্ষ।
ছবির উৎস, Getty Images
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০০৭ সাল থেকে মিসর ও ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় চলাচল ও প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিয়ণ্ত্রণ করে আসছে।
ফিলিস্তিনিদের সাথে ইরান আর ইসরায়েলের সাথে যুক্তরাষ্ট্র
বিভিন্ন রিপোর্ট সূত্রে বিবিসি জানতে পেরেছে যে ইরান এই ফিলিস্তিনি হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
ইরানের সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ-র খবর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির উপদেষ্টা ইসরায়েলের উপর ফিলিস্তিনি হামলার পক্ষে কথা বলেছেন।
রহিম সাফাভি বলেছেন, “আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই, যতক্ষণ ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের স্বাধীনতা না আসে আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশে থাকবো”, আইএসএনএ-এমনটি লিখেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই হামলার নিন্দা জানিয়ে দুই পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধের আহবান জানায়। পরবর্তীতে এক বিবৃতিতে দেশটির ডিফেন্স সেক্রেটারি লয়েড অস্টিন বলেন ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
“আমি গভীরভাবে ইসরায়েলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষা এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগ কাজ করবে।”
এদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইসরায়েলের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, “আমি সকাল বেলা ইসরায়েলি নাগরিকদের উপর হামাস সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলার খবরে মর্মাহত। ইসরায়েলের তাদের নিজেদের রক্ষা করার সবরকম অধিকার আছে।”
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তীব্র ভাষায় এই হামলার সমালোচনা করে বলেছেন, “আমি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের প্রতি আমার পূর্ণ সমবেদনা জানাই।”
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “নিরীহ বেসামরিক লোকদের উপর সহিংসতা ও রকেট হামলা এখনি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইউরোপিয়ান কমিশনও। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন এই হামলাকে ‘জঘন্য সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হল, “আমরা সবসময় সবার সংযত আচরণ আশা করি।”