ছবির উৎস, Getty Images
মনিপুর বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী এন. বিরেন সিংয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করছে বিক্ষোভকারীরা। ছবিটি গত ৮ই সেপ্টেম্বর তোলা।
ভারতের মনিপুর রাজ্যে দুই ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। রাজধানী ইম্ফলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে মঙ্গলবারের মতোই।
সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে আবারও ইম্ফলে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন আরও ছয়মাসের জন্য জারি করার কথা ঘোষণা করেছে সরকার।
গত জুলাই মাসে ইম্ফলের দুই ছাত্রছাত্রী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের। প্রায় চার মাস বন্ধ থাকার পরে গত শনিবার রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা চালুর পরে সোমবার ওই দুই ছাত্রছাত্রীর নৃশংস মৃত্যুর ছবি ভাইরাল হয়ে যায়।
ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা গেছে ওই দুই ছাত্রছাত্রী জড়োসড়ো হয়ে ঘাসের ওপরে বসে আছে আর পিছনে বন্দুকধারী দুই ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। এর পরের ছবিটিতে ওই দুই ছাত্রছাত্রীর মৃতদেহ দেখা যায়।
মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ঘোষণা করেছেন যে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই ইতোমধ্যে ঘটনার তদন্ত হাতে নিয়েছে। বুধবার দিল্লি থেকে সিবিআইয়ের একটি দল ইম্ফল পৌঁছেছে।
ছবির উৎস, Getty Images
মঙ্গল ও বুধবার ব্যাপক বিক্ষোভ হয় রাজধানী ইম্ফলে
স্কুলের পোশাকে বিক্ষোভে ছাত্রছাত্রীরা
ইম্ফলের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলবারে দিনের বেলা বিক্ষোভে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনা গেলেও রাতে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীরা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিলেন।
বুধবার সকালে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছেই কাংলা দুর্গের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের প্রথম দিনেও লাঠি চার্জ আর কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়েছে পুলিশ। বুধবারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে লাঠি চার্জ আর কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েছে পুলিশ।
গত দুদিনের বিক্ষোভে স্কুলের পোশাক পরেই ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছিল, সঙ্গে ছিল কলেজ ছাত্রছাত্রীরাও।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে মঙ্গলবারের বিক্ষোভে অন্তত ৫০ জন ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর।
ছবির উৎস, Getty Images
সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন আরও ছয়মাসের জন্য বলবত করা হল বুধবার থেকে
ফের কারফিউ, সেনাকে বিশেষ ক্ষমতা
বুধবারের বিক্ষোভের পরেই ইম্ফলে ফের কারফিউ জারি করে দেওয়া হয়েছে। এই বিক্ষোভের জেরে মঙ্গলবার থেকেই আবারও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার বিকেলে মনিপুরের স্বরাষ্ট্র দপ্তর এক ঘোষণায় জানিয়েছে যে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন মনিপুরের ১৯টি থানা এলাকা বাদে বাকি সব জায়গায় আরও ছয় মাসের জন্য চালু থাকবে। এই আইন জারি করা হচ্ছে মূলত পার্বত্য এলাকায়, যেখানে সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস।
বিতর্কিত এই আইনে সেনাবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সৈন্যরা ভুল করেও কোন বেসামরিক লোককে হত্যা করলে এর জন্য কোন সেনা সদস্যের সাজা হয় না। উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক রাজ্যেই এই আইনটি কার্যকর আছে।
অন্যদিকে, মণিপুরে প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলা জাতিগত সহিংসতার সময়ে আদিবাসীদের হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনাগুলির সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে কেন দেরি করল সরকার, সেই প্রশ্ন তুলে চুড়াচাঁদপুরে বিক্ষোভ দেখায় আদিবাসী সংগঠনগুলি।
ছবির উৎস, Getty Images
চার মাস ধরে সহিংসতা চলছে মনিপুরে
গোষ্ঠী সংঘর্ষের শুরু যেভাবে
মনিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে তপশীলি উপজাতি বা এসটি তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের বসবাস মূলত ইম্ফল উপত্যকায়।
এদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন যে আদিবাসীরা, তাদের একটা বড় অংশ মূলত কুকি চিন জনগোষ্ঠীর মানুষ। সেখানে নাগা কুকিরাও যেমন থাকেন কিছু সংখ্যায়, তেমনই আরও অনেক গোষ্ঠী আছে।
মেইতেইরা তপশীলি উপজাতির তকমা পেয়ে গেলে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত হবেন, এই আশঙ্কা ছিলই।
কিন্তু ৩রা মে, হাইকোর্ট মেইতেইদের তপশীলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করতে বলে।
তার বিরুদ্ধে পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠী বিক্ষোভ মিছিল করে বুধবার। সহিংসতার শুরু সেখান থেকেই, যা খুব দ্রুত পুরো রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।
তপশীলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ আসার আগে থেকেই অবশ্য সরকারের এবং মেইতেইদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন পাহাড়ি উপজাতিরা।
ওইসব পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সরকার ‘বেআইনি দখলদার’ সরাতে শুরু করেছিল সম্প্রতি। এগুলি সবই নাগা এবং কুকিদের বসবাসের এলাকা ছিল।
সহিংসতা শুরু হতেই কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী এবং সেনা মোতায়েন করা হয় মনিপুরে।
তাও কুকি এবং মেইতেদের মধ্যে সংঘর্ষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নি।
আপাতত কুকি-প্রধান এলাকা ও মেইতেই প্রধান এলাকা ভাগাভাগি হয়ে আছে, মাঝে অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনী।
পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই হওয়া প্রচুর অস্ত্র এখন দুই সম্প্রদায়ের বেসামরিক নাগরিকদের হাতে রয়েছে। তারা সেগুলো নিয়েই নিজনিজ এলাকা পাহারা দিচ্ছেন।
ছবির উৎস, Getty Images
ইম্ফলের রাস্তায় চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল
নারী নির্যাতনের ঘটনা
জুলাই মাসে দুজন কুকি মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় নগ্ন করে ঘোরানোর একটি ভিডিও সামনে আসে। মনিপুরের সঙ্গেই গোটা ভারতেই ব্যাপক প্রতিবাদ হয় সেই ঘটনার।
ভিডিওতে দেখা যায়, মণিপুরের রাস্তায় কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের দু’জন নারীকে নগ্ন করে একদল লোক রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের ক্রমাগত যৌন লাঞ্ছনা করা হচ্ছে।
দু’জন নারীর একজনের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি-বাইশ, অন্যজনের চল্লিশের আশেপাশে।
ভিডিওতে দেখা যায়, জনতার মধ্যে অনেকেই ওই নারীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ খামচে ধরছে। এরপর তাদের জোর করে একটি চাষের ক্ষেতের দিকে টেনে নিয়ে যেতেও দেখা যায়।
অভিযোগ, তুলনায় কম বয়সী মেয়েটিকে প্রকাশ্য দিবালোকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছিল।