ছবির উৎস, Getty Images
একজন ডায়াবেটিক নারী নিজেই ইনসুলিন গ্রহণ করছেন
গত প্রায় দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস, অর্থাৎ বহুমূত্র রোগে ভুগছেন পটুয়াখালীর বাসিন্দা মাহমুদ ওসমান গনি। কিন্তু এত বছরেও তিনি কখনও ইনসুলিন গ্রহণ করেন নি।
ইনসুলিন নেয়ার পরিবর্তে ওষুধ সেবন ও নিজের দৈনন্দিন কিছু অভ্যাসকে পরিমার্জন করার মাঝ দিয়ে আজীবনের রোগ ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান মি. ওসমান।
তিনি বলেন, “ইনসুলিন একবার নেয়া শুরু করলে আর বন্ধ করা যায় না। সেজন্য যতদিন পারি, ঔষধটাই খাবো। আর, ইনসুলিন মানেই ফোঁড়াফুঁড়ি, বিষয়টা ভালো লাগে না।”
মি. ওসমানের ডায়াবেটিসের মাত্রা সাধারণত গড়ে ৮ মিলি.মোল/লি. এর কাছাকাছি থাকে। ডাক্তারদের মতে, এই মাত্রার ডায়াবেটিস থাকলে ইনসুলিন না নিলেও হয়।
কিন্তু ২০ মিলি.মোল/লি. মাত্রার ডায়াবেটিস নিয়েও ইনসুলিন নিতে চান না রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ জাহিদা আক্তারেরও।
তার মেয়ে মিজ সূচনা জানান, গত দশ বছর ধরে তার মা এই রোগে আক্রান্ত এবং প্রায়ই তার মায়ের ডায়াবেটিসের মাত্রা ২০ এর ওপর চলে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে ইনসুলিন নেয়া জরুরি হলেও তিনি তা একদমই গ্রহণ করতে চান না।
মিজ সূচনা বলেন, “ইনসুলিনটা দিতে হয় পেটে বা উরুতে, যেটা মায়ের জন্য অস্বস্তিকর। এছাড়া, ইনসুলিন দেয়ার সময় যেহেতু অবশ করে নেয় না, তাই এটা খুব পেইনফুল।”
ইনসুলিন আসলে কী?
পৃথিবীতে এমন অনেকে আছেন, যারা ইনসুলিন নিতে ভয় পান। কিন্তু, এই ইনসুলিন আসলে কী?
ইনসুলিন হলো মানবদেহের জন্য এক অপরিহার্য হরমোন, যা অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয়।
মানুষ যখন কোনো খাবার খায়, তখন মানুষের শরীর সেই খাবারকে ভেঙ্গে চিনি বা গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে। আর, ইনসুলিন শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয়, সেই চিনিকে গ্রহণ করার জন্য। এই চিনি মানবদেহের জ্বালানি বা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু অগ্ন্যাশয় যখন শরীরে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অর্থাৎ, শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘বহুমূত্র রোগ’ হয়।
এমন পরিস্থিতিতে মানবদেহকে সুস্থ রাখার জন্য বাইরে থেকে কৃত্রিম ইনসুলিন দিতে হয়।
ইনসুলিন কখন দিতে হয়?
এই কৃত্রিম ইনসুলিন আবিষ্কৃত হয় ১৯২১ সালে। তার আগ পর্যন্ত ডায়াবেটিস রোগীরা শরীরে ইনসুলিনের অভাবের কারণে মারা যেতেন।
কারণ ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা—এর যেকোনো একটি বা দু’টোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বাড়তে থাকে।
আর গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দেহের টিস্যু ও যন্ত্র বিকল হওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র তথ্য অনুযায়ী, অভুক্ত অবস্থায় যদি মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৭ মিলি.মোল/লি এর বেশি পাওয়া যায়, তাহলে তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।
কিন্তু এই মাত্রার গ্লুকোজ থাকলেই রোগীকে ইনসুলিন গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ডায়াবেটিসের মাত্রা যদি ১৬ দশমিক ৭ মিলি.মোল/লি এর উপরে চলে যায়, তখন রোগীকে সাধারণত কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।
এক্ষেত্রে, ইনসুলিন দেয়া হয় ইনজেকশন বা ইনজেক্ট্যাবল কলম বা পাম্পের মাধ্যমে।
কাদের ইনসুলিন নিতে হবে?
ছবির উৎস, Getty Images
ইনসুলিন গ্রহণের কোনও নেতিবাচক প্রভাব নেই
ইনসুলিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সবসময় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার উপর নির্ভর করে না।
রোগীকে ইনজেক্ট্যাবল ইনসুলিন নিতে হবে নাকি হবে না, তা নির্ভর করছে রোগী কোন ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সেই বিষয়টির উপর।
ডায়াবেটিস হয় মূলত দুই ধরনের। এগুলো হলো: টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু ডায়াবেটিস।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস মূলত বংশগত, অর্থাৎ জেনেটিক কারণে হয়। এর জন্য বাহ্যিক কোনও কারণ দায়ী না।
সাধারণত তরুণ বয়সে, অর্থাৎ ১৮ বছরের আগেই এটি শুরু হয়। ডায়াবেটিসের এই ধরন দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একবারেই থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্র’র (সিডিসি) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণেই কোন ব্যক্তি টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
অর্থাৎ, শরীর ভুল করে নিজেকে আক্রমণ করে এবং নিজেই ইনসুলিন তৈরি বন্ধ করে দেয়।
ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ মানুষের টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস আছে। একজন মানুষের যেকোনো বয়সে এই টাইপটি ধরা পড়তে পারে।
ছবির উৎস, Getty Images
ডায়াবেটিস পরিমাপের যন্ত্র
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, “টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস তরুণ বয়সে শুরু হয়। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস যাদের, তাদেরকে ইনসুলিন দিতেই হবে। কারণ এই হরমোন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।”
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে গ্লুকোজের মাত্রা মূখ্য না বোঝাতে তিনি বলেন, “কত-টত’র বিষয় না। তাকে ইনসুলিন না দিলে সে আজ হোক কাল হোক, মরে যাবেই।”
অন্যটিতে, অর্থাৎ টাইপ টু ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত, তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না। অথবা, এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না।
পৃথিবীতে টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি এবং এই রোগীদের ক্ষেত্রে অনেকসময় চিকিৎসকরা ইনজেক্ট্যাবল ইনসুলিন দিয়ে থাকেন।
ড. খান বলেন, “একজন টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগী, যার শরীরে ইনসুলিন আছে; কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত না। তখন তাকে ঔষধ, ডায়েট, এক্সারসাইজ দেয়া হয়। কিন্তু এগুলা দিয়েও যখন তার সুগার কন্ট্রোল করা যায় না, তখন তাকে বাইরে থেকে ইনসুলিন দেয়া হয়।”
তিনি বলেন, ডায়াবেটিসের প্রথম ধরণটি তরুণ বয়সে দেখা গেলেও, দ্বিতীয় ধরন দ্বারা সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
ইনসুলিনের নেতিবাচক প্রভাব আছে?
ছবির উৎস, Getty Images
নিয়মিত শরীরচর্চা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়
প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লিখিত মি. ওসমানের মতো বেশিরভাগ মানুষের মাঝে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে ইনজেক্ট্যাবল ইনসুলিন একবার গ্রহণ করলে তা আর বন্ধ করা যায় না।
কিন্তু এটি আসলে একটি ভুল ধারণা। ইনসুলিন গ্রহণের কোনও নেতিবাচক প্রভাব নেই।
কোনও রোগী কিছুদিন ইনসুলিন গ্রহণ করার পর তা বন্ধ করে দিতে পারে কিনা জানতে চাইলে ড. খান বলেন, “শরীরে ইনসুলিন কমে গেলে রোগীকে ইনসুলিন নিতে হয়। কিন্তু সুগার কন্ট্রোল হয়ে গেলে আবার তা বন্ধ করা যেতে পারে।”
সুগার নিয়ন্ত্রণে চলে এলে রোগী জীবনযাত্রাকে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মাঝে রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফের ঔষধ সেবন করতে পারেন বলে জানান তিনি।
তবে অতিরিক্ত ইনসুলিন গ্রহণ করলে রোগীর হাইপারগ্লাইসিমিয়া হয়ে যেতে পারে। “কারণ ব্লাড সুগার বেশি হয়ে গেলে তা ইনসুলিনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।”
রক্তে সুগারের পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়াকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে।