ছবির উৎস, Anowar Hossain
বাংলাদেশের কুমিল্লায় যৌথবাহিনীর হাতে আটক হয়ে হেফাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের কমান্ডারকে প্রত্যাহার করে ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’ গঠনের কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর।
সংস্থাটি জানিয়েছে তদন্তে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সেনা আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ওদিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনার জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
নিহত ব্যক্তির নাম তৌহিদুল ইসলাম বলে জানিয়েছে তার পরিবার। তবে আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে তার নাম তৌহিদুর রহমান উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের বিবৃতিতেও তার নাম তৌহিদুল ইসলাম বলা হয়েছে।
নিহত তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহবায়ক ছিলেন বলে জানিয়েছেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ।
মি. আজাদ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে কুমিল্লায় তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘ঘটনার জন্য দায়ীদের’ সেনা আইনে বিচারের অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এদিকে যৌথ বাহিনীর হাতে আটকের পর মারা যাওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা আজ শনিবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
সামাজিক মাধ্যমেও এ ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে একে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।
ওদিকে নিহত তৌহিদুর রহমানের পোস্ট মর্টেম শেষ হয়েছে এবং শনিবার বিকেলেই তার জানাজা ও দাফন হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ভাই।
ছবির উৎস, ISPR
কী ঘটেছিলো
কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন নিহত তৌহিদুল ইসলামকে শুক্রবার পুলিশ অসুস্থ অবস্থায় পেয়েছিলো।
“অসুস্থ অবস্থায় পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেছি। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। এখন পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পাওয়া যাবে,” বলছিলেন তিনি।
তিনি জানান শুক্রবার বেলা এগারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে থানা পুলিশকে জানানো হয়। এরপর পুলিশ যখন তাকে গ্রহণ করে তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন।
পুলিশের মধ্যে যারা তৌহিদুল ইসলামকে সেনাসদস্যদের হাত থেকে গ্রহণ করেন তার মধ্যে ছিলেন স্থানীয় কোতোয়ালি থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, সেনাসদস্যদের হাত থেকে মি. ইসলামকে যখন নিজেদের কাছে নেন তখনো তার জ্ঞান ছিলো কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারান।
“আমরা দ্রুত তাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নেই। সাথে সাথে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দিলে সেখানেই নিয়ে যাই ও পরিবারের সদস্যদের সেখানে আসতে বলি। সেখানেই ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
পরিবারের সদস্য হিসেবে সেখানে ছিলেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। মি. আজাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন হাসপাতালে তার ভাইয়ের শরীরে ‘নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো স্পষ্ট’।
“তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই,” বলছিলেন তিনি।
ছবির উৎস, Masud alam
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান তাদের বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে রবিবার তার ভাই চট্টগ্রাম থেকে বাড়িতে এসেছিলো। তিনি সেখানে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
“রাজনীতি করতো। আওয়ামী লীগ আমলে এলাকায় থাকতে পারতো না। চট্টগ্রাম গিয়ে চাকরি করতো। সেখান থেকেই এসেছিলো। বৃহস্পতিবার রাতে বাবার কুলখানির আয়োজন নিয়ে কাজ করছিলাম আমরা। মধ্যরাতে সেনাসদস্যরা চারজন সিভিল লোকজনসহ এসে তাকে নিয়ে যায়,” বলছিলেন নিহত তৌহিদুল ইসলামের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ।
তিনি জানান, “সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকেই তৌহিদকে আটক করেন। পুরো ঘরে তল্লাশি করেন। এক পর্যায়ে গাড়িতে করে আমার ভাইকে নিয়ে যায়। শুধু বলেছে নির্দোষ হলে ফেরত দিয়ে যাবে। শুক্রবার সকালেও সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িতে এসে তল্লাশি করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা লাশটা দিলো”।
নিহত তৌহিদুল ইসলাম বিবাহিত ও চার কন্যা সন্তানের জনক। পরিবারের চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তার মা আগেই মারা গিয়েছিলেন।
“আমার ভাই রাজনীতি করতো কিন্তু তার নামে কোন অভিযোগ নেই। কোন মামলাও ছিলো না। বিএনপির রাজনীতি করতো,” বলছিলেন মি. আজাদ। তার অভিযোগ শুক্রবার সকালেও যখন সেনা সদস্যরা তল্লাশিতে আসেন তখন তৌহিদুলকে গাড়িতেই রাখা হয়েছিলো।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ তারা হাসপাতালে তৌহিদুল ইসলামের শরীরের বিভিন্ন অংশে জখমের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন।
শুক্রবার যৌথ বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। সামাজিক মাধ্যমেই ‘নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর’ তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা আজ দুপুরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
সকাল দশটার দিকে ইটাল্লা গ্রামের মৃতদেহবাহী গাড়ী নিয়েই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে গ্রামবাসী। পরে দুপুর বারটার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে আরেকটি মানববন্ধনে তার পরিবার ও এলাকাবাসী অংশ নেয়।
সেই কর্মসূচিতে অংশ নেয়া তৌহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাই আনোয়ার হোসেন জানান ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে দায়ীদের সেনা আইনে বিচারের কথা জানিয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের মাধ্যমেও নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীকে ঘটনার বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ছবির উৎস, Masud alam
কিন্তু তৌহিদুলকে কেন আটক করা হলো?
আইএসপিআর তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে “গত ৩১শে জানুয়ারি ২০২৫ আনুমানিক ০৩০০ ঘটিকায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যৌথবাহিনীর অভিযানে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা হতে আটককৃত মোঃ তৌহিদুর রহমান (৪০) একই দিন ১২৩০ ঘটিকায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন”।
“এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনাটি তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে উক্ত সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়াও মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনের জন্য একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে”।
কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আটকের কথা বললেও অভিযোগগুলো কী তা উল্লেখ করেনি।
তবে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন ইটাল্লা এলাকায় তাদের পৈত্রিক সম্পদ নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিরোধ চলছিলো। বুধবার আরও কয়েকজনকে নিয়ে তৌহিদুর ইসলাম সেখানে গিয়েছিলেন। তাদের দাবি, এ ঘটনার পর একটি পক্ষ সেনাক্যাম্পে অভিযোগ করার পর যৌথবাহিনী অভিযান চালায়।
“এরপরই তাকে আটক করে বিভিন্ন জায়গায় রাতেই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চালানো হয়। সম্ভবত ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদের সময় করা নির্যাতনের কারণেই তিনি প্রাণ হারিয়েছেন,” নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।
তবে তৌহিদুল ইসলামের ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেছেন সেনা সদস্যরা তাদের ঘর তল্লাশির সময় বারবার জিজ্ঞেস করেছে অস্ত্র কোথায়।
“তারা অস্ত্র খুঁজছিলো। তাদের সাথে চার জন সিভিল লোক ছিলো। এক পর্যায়ে আমার ভাইকে নিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর বাইরে বেসামরিক যারা জড়িত, যারা সেনাবাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন।